সাজেদুল হক: মিন্টো রোডের নতুন ঠিকানায় কেমন আছেন মাহমুদুর রহমান- তা
অনুমান করা যায়, অনুভব করা না গেলেও। এ পরিস্থিতিতে পড়তে পারেন সে আশঙ্কা
তার ছিল। চার মাস আগে যখন নিজ কার্যালয়ে বন্দি হলেন তখন ‘এক অবরুদ্ধ
বাইচান্স সম্পাদকের জবানবন্দিতে’ বয়ান করেছিলেন সে কথা। ঈমান নিয়ে মৃত্যুই
ছিল তার একমাত্র চাওয়া। তবে আপাত ১৩ দিনের রিমান্ড জীবনের শুরুতে অভাবনীয়
দু’টি দুঃসংবাদ পেয়েছেন তিনি। চার বছর ধরে তার সম্পাদনায় প্রকাশিত দৈনিক
আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে অশালীন কৌশলে। পত্রিকাটির
প্রেস সিলগালা করে দেয়ার পর বিকল্প ব্যবস্থায় প্রকাশনার চেষ্টা করেন
সংবাদকর্মীরা। কিন্তু বিকল্প প্রেসে হানা দিয়ে সেখান থেকে গ্রেপ্তার করা
হয়েছে সব প্রেস কর্মীকে। মাহমুদুর রহমানের বৃদ্ধ মাতাকেও এ ঘটনায় দায়ের করা
মামলায় আসামি করা হয়েছে। যিনি ছেলের গ্রেপ্তারের পর আমার দেশ
পাবলিকেশন্সের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালন করছিলেন। স্রোতের
বিপরীতের যাত্রী মাহমুদুর রহমান যখন বৃহস্পতিবার সকালে গ্রেপ্তার হন তখন
নানা তাত্ত্বিক প্রশ্নের ওপর আলোচনা আবার নতুন করে শুরু হয়েছে। ৫৯ বছর বয়সী
এ ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক পেশায় ছিলেন প্রকৌশলী। ছাত্র জীবন কাটিয়েছেন
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ
ইন্সটিটিউটে। তিনি প্রথম প্রচারের আলোয় আসেন বিগত-বিএনপি জামায়াত জোট
সরকারের জমানায়। খালেদা জিয়া সরকারের জ্বালানী উপদেষ্টার দায়িত্ব বর্তায়
তার ওপর। জরুরি জমানার কঠিন সময়ে কলাম লেখক হিসেবে আবির্ভাব ঘটে মাহমুদুর
রহমানের। ফখরুদ্দীন সরকারের তীব্র সমালোচনা করে দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায়
নিয়মিত কলাম লেখা শুরু করেন তিনি। একপর্যায়ে আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত
সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট
সরকার। সরকারের তীব্র সমালোচনামূলক লেখার কারণে রোষানলে পড়েন ক্ষমতাবানদের।
প্রধানমন্ত্রীর ছেলের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করা হয় তার পত্রিকায়।
গ্রেপ্তার হন মাহমুদুর রহমান। আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন
সুপ্রিম কোর্টে। ছয় মাসের কারাদণ্ড আর এক লাখ টাকা জরিমানার রেকর্ড সাজা
দেয়া হয় তাকে। নয় মাস কারাভোগের পর সেদফায় মুক্তি মিলে তার। সে মামলার
শুনানিকালেই একজন বিচারপতি তাকে অভিহিত করেন বাইচান্স এডিটর হিসেবে।
মাহমুদুর রহমান আবার আলোচনার শীর্ষে চলে আসেন যখন চার মাস পূর্বে তার
পত্রিকায় বিচারপতি নিজামুল হকের স্কাইপ কথোপকথন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা
হয়। যে সংবাদের জেরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে পদত্যাগ করেন
বিচারপতি হক। তবে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধেও দায়ের করা হয় মামলা। সেসময়
থেকে নিজ কার্যালয়েই বন্দি জীবন কাটাতে থাকেন। এরইমধ্যে ঘটে যায় শাহবাগ
অভ্যুত্থানের মতো ঘটনা। শুরুর দিন থেকে একমাত্র আমার দেশই সরব থাকে এ
অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে। শাহবাগে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনির খবর দেয় পত্রিকাটি।
একসময় মঞ্চে আবির্ভাব ঘটে হেফাজতে ইসলামের। দমবন্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়
পুরো রাষ্ট্রেই। এ অবস্থায় পুরনো মামলায় আবার গ্রেপ্তার হলেন মাহমুদুর
রহমান। টিভি টকশোতে অনেক বিজ্ঞ সম্পাদক তার সাংবাদিকতার পরিচয় নিয়েই প্রশ্ন
তুলেছেন। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই মাহমুদুর রহমানও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন।
নবম সংসদ নির্বাচনের আগে তার ব্যবসায়িক কার্যালয়ে শীর্ষ আমলাদের বৈঠক
সমালোচনার ঝড় তুলেছিল। মাহমুদুর রহমানের নিজের এবং তার পত্রিকায় প্রকাশিত
লেখায় আক্রমণাত্মক উপাদান অনেক ক্ষেত্রেই সাংবাদিকতার সীমা লঙ্ঘন করেছে।
কিন্তু মাহমুদুর রহমানের গ্রেপ্তারে যারা উল্লাস প্রকাশ করছেন দুই দিন আগেও
ব্লগারদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে সাফাই গেয়েছেন তারা। এই বুঝি
বাঙালি মুসলমানের মন। এই শিক্ষিতজনরা নিশ্চয়ই ফরাসি দার্শনিক ভলতেয়ারের সেই
অমর উক্তির সঙ্গে পরিচিত। তিনি বলেছিলেন, আমি তোমার মতের সঙ্গে একমত না
হতে পারি, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের অধিকার আমি জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করবো।
তবে মাহমুদুর রহমানের গ্রেপ্তারের চেয়ে বড় আঘাত এসেছে ফোর্থ স্টেট খ্যাত
সংবাদ মাধ্যমের ওপর। পুলিশি হানায় আমার দেশ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হয়ে
গেছে। আইন আদালত কোন কিছুরই তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। মামলা করা হয়েছে
সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদের বিরুদ্ধেও। আরও কিছু সংবাদ মাধ্যম বন্ধের
গুঞ্জনও ছড়িয়ে পড়েছে। এ ইঙ্গিত কারও জন্যই শুভ নয়। যারা ভাবছেন, অন্ধ হলেই
প্রলয় বন্ধ থাকবে তারা ভুল করছেন। এ প্রলয় একদিন আপনার বাড়িতেও আঘাত হানতে
পারে। এ অন্ধকার সময়ে একটি কথাই বারবার ফিরে আসছে, ‘ইতিহাসের সবচেয়ে
বড়শিক্ষা হলো এই যে মানুষ ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না।’