আল্লামা আহমদে শফী'র "জীবন ও র্কম"

আল্লামা আহমদে শফী'র "জীবন ও র্কম"

সৃষ্টির সূচনাকাল থেকেই আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত মানবজাতিকে সত্য, সুন্দর কল্যাণ ও মুক্তির আলোকিত তুলে আনার জন্য ওয়াজ-নসিহত, শিক্ষা ও তরবিয়্যতের মিশনে নিয়োজিত থেকেছেন নবী-রাসূলের উত্তরসূরি আলিম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ, অলি-আউলিয়া। বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন : 
’(হে মুহাম্মদ সা.) আপনি (মানবজাতিকে) হিকমাত ও সুন্দর উপদেশ প্রদানের মাধ্যমে আপনার প্রভুর পথে আহবান করুন।’
আল্লাহ প্রদত্ত এ দায়িত্ব পালনকে জীবনের প্রধান লক্ষ্যরুপে নির্ধারণ করেছেন এবং উদ্দেশ্যকে সফল করতে পার্থিব সম্পদ-ঐশ্বর্য, সুখ-স্বাচ্ছন্দ ও যাবতীয় লোভ-লালসা, ভয়ভীতি, তিরস্কার-ভৎর্সনা উপেক্ষা করে হকের দাওয়াতী মশাল প্রজ্জ্বলিত রেখেছেন। কেয়ামত পর্যন্ত ইনশা’আল্লাহ এই প্রদীপ আলো ছড়াবে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি  ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেছেন, 
’আমার উম্মতের একটি দল সর্বাবস্থায় সত্যেও ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, শত্রুরা তাদেও কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ 
সুতরাং কোনো শতাব্দী, কোনো যুগ সত্যপন্থী এই পবিত্র দলের তৎপরতাবিহীন থাকবে না। প্রত্যেক যুগের এদেও একটি কাফেলা থাকবে; যারা ইসলামের প্রচার, উপস্থাপন ও আল্লাহর বাণীকে সর্বোচ্চে তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা অব্যাহত রাখবে। আল্লাহর পথের দাঈ ও রাসূলের আদর্শেও পতাকাবাহী দীনের এই সৈনিকরা পৃথিবীর মহামূল্যবান সম্পদ। জনসমাজে, ইতিহাসের পাতায় ও মানুষের হৃদয়ে তারা চিরদিন রাজত্ব করেন, ইহজগত থেকে শারীরিকভাবে লোকান্তরিত হয়েও জগতে তাঁরা বেঁচে থাকেন চিরকাল।

উপমাহাদেশের এমন ক্ষণজন্ম মহাপুরুষদের অন্যতম হলেন, দেশবরেণ্য  আলিমেদীন, অলিয়ে কামেল, শায়খুল ইসলাম হযরত আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানীর (রাহ.) অন্যতম খলিফা, দেশের প্রাচীন ও বৃহৎ দীনি দরসেগাহ জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর মুহতামিম, শায়খুল আল্লামা শাহ আহমদ শফী। যার কৈশৌর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব আর বার্ধক্য ইলম, আমল, ইখলাস (আত্মশুদ্ধি), দাওয়াতের পূণ্যময় আলোয় উদ্ভাসিত। গোটা জাতির অবিসংবাদিত এই আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক একাধারে মেধাবী আলিম, সফল শিক্ষক, পরিশুদ্ধ সাধক, দূরদর্শী সমাজসংস্কারক, সংযমী, বিনয়ী, সদালাপী, মিষ্টভাষী, যু্ক্তিবাদী, উদার ও পরম  স্নেহবৎসল এক জ্যোর্তিময় ব্যক্তিত্ব।
পঙ্কিলতার আবর্তে ডুবে যাওয়া সমাজে আত্মশুদ্ধির মঞ্চে শুদ্ধতার ছড়ি হাতে এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্বের ধীর অথচ দৃঢ় কদমে অগ্রসরমান এক শান্ত-সমাহিত ব্যক্তিত্বের আলেখ্য পাঠকের হাতে তুলে দিতে চাই। ভক্তপ্রাণের হৃদয়নদে দু’কুল ছাপিয়ে বহমান অঢেল প্রশান্তির শূর্তপ্রতীক শ্বেতশুভ্র পোষাকে অনিন্দ্যসুন্দর এক অসাধারণ মানুষের কাহিনী হয়রত আল্লামা শাহ আহমদ শফী সাহেব (দা.বা.) এই সংক্ষিপ্ত ’জীবন কথা’।


জন্ম, বেড়ে ওঠা শিক্ষা-দীক্ষা পর্ব

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ১৩৫১ হিজরী সালে বার আউলিয়ার পূর্ণভুমি বীর চট্টলার রাঙ্গুনিয়া থানাধীন পাখিয়ার টিলা নামক গ্রামে এক অভিজাত, সম্ভ্রান্ত ও ঐতিহ্যবাহী দীনদান পরিবারে আল্লামা শাহ আহমদ শফীর জন্ম। তাঁর ভাগ্যবান পিতা জনাব বরকত আলী ও রতœগর্ভা মাতা মেহেরুন নেসা বেগম। নবজাতক আহমদ শফীর জন্মের পর মা-বাবা তাদের নয়নমনি, প্রিয় সন্তানকে মুসলিম উম্মাহর পথনির্দেশক হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন বুনতে থাকেন। মহান আল্লাহ, তাঁদের এ মহৎ স্বপ্ন অপূর্ণ রাখেননি। শৈশবে তাঁর পিতা-মাতা শিশু আহমদ শফীকে পবিত্র কুরআন শিক্ষা দেবার মৌলভী আজিজুর রহমানের কাছে প্রেরণ করেন। সমান্তরালে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গেই চতুর্থ শ্রেণী পর্যনত্ সাধারণ শিক্ষার পাঠক্রম সম্পন্ন করেন। এরপর সরফভাটা মাদ্রাসায় প্রাথমিক কিতাবাদি অধ্যয়ন শুরু করেন। ছোট বেলা থেকেই অত্যন্ত ন¤্র, বিনয়ী, চিন্তাশীল, প্রখর মেধাবী, তীক্ষèধীরশক্তির, অধিকারী হওয়া বয়সেই তিনি কুরআনের কারিমের নাজার, প্রাথমিক শিক্ষাস্তর কৃতিত্বের সঙ্গে সমাপ্ত করেন। অতঃপর কিশোর আহমদ শফী মাধ্যমিক স্তরের পড়ালেখার উদ্দেশ্যে দক্ষিণ চট্টগ্রামের এতিহ্যবাহী প্রাচীর ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আল-জামিয়া আল আরবিয়া জিরি-তে ভর্তি হন। সেখানে ৫/৬ মাস অধ্যয়ন করার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঢংকা বেজে উঠার পরিপ্রেক্ষিতে ১৩৬১ হিজরীতে তাাঁর শ্রদ্ধাস্পদ হিতাকাক্সক্ষী হাফেজ ইমতিয়াজের প্রচেষ্টায় এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম হাটহাজারীতে ভর্তি হন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১০ বছর। দশ বছরের বালক আহমদ শফীকে এ বয়সেই শোক সাগরে ভাসিয়ে মাতা-পিতা দু’জন পরপর ইন্তেকালা করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)।

দারুল উলূম হাটহাজারীতে তিনি টানা দশ বছর আত্মত্যাগ, কঠোর ধৈর্য, সদাচার, লেখাপড়ায় গভীর অভিনিবেশ ইত্যাদি গুণাবলির কারণে উস্তাদমহলের বিশেষ  স্নেহভাজন ছাত্রে পরিণত হন। এখানে এক দশক অতিক্রান্ত হল। সম-সাময়িক বিজ্ঞ আলিমদের স্নেহধন্য সান্নিধ্যে থেকে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের দক্ষ উস্তাদদের প্রত্যক্ষ তত্ত্ববধানে আরবি সাহিত্য, ব্যাকরণ, নাহু-সরফ, ইলমে ফিকহ, মানতিক (যুক্তিবিদ্যা), দর্শন, বালাগাত (আরবী ভাষার অলঙ্কারশাস্ত্র) প্রভৃতি বিষয়ে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।

দারুল উলূম মুইনুল ইসলাম হাটহাজারীতে তিনি দেশের শীর্ষ আলিম ও বুজর্গ ব্যক্তিত্বগণের কাছে সরাসরি শিক্ষাগ্রহণের সৌভাজ্য অর্জন করেরন। তাঁর উস্তাদগণের মধ্যে খ্যাতিমান আলিমেদীন, সমাজসংস্কারক, উপমহাদেশের প্রখ্যাত আইনবিশারদ আল্লামা মুফতিয়ে আযম হযরত মাওলানা ফয়েজুল্লাহ (রাহ.), শায়খুল হাদিস আল্লামা সুফী আবদুল কাইয়ুম (রাহ.), শায়খুল আদব আল্লামা মুহাম্মদ আলী নিজামপুরী (রাহ.) ও আল্লামা শায়খ আবুল হাসান (রাহ.) এর নাম প্রণিধানযোগ্য।


উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে দারুল উলূম দেওবন্দ যাত্রা

নবীপ্রেমিক এই বুজর্গের বল্যকাল, প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষার সময়-প্রবাহ ছিল, বৈচিত্রময় ও চাঞ্চল্যকর ঘটনায় পূর্ণ। ১৩৭১ হিজরী সালে তিনি উচ্চ শিক্ষার অদম্য আগ্রহ ও জ্ঞানার্জনের প্রবল তৃষ্ণা নিয়ে ছুটে যান উপমহাদেশের বৃহত্তম ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্র, ঐতিহ্যবাহী হাদিস শিক্ষার পাদপীঠ, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম সূতিকার দারুল উলূম দেওবন্দে। দারুল উলূম দেওবন্দে তিনি হাদিস, তাফসীর প্রভৃতি উচ্চতর বিশেষায়িত কোর্স সম্পন্ন করেন। দারুল উলূম দেওবন্দে অধ্যয়নকালে তিনি যাঁদের সংশ্রব লাভে করেন তাদের সর্বাগ্রে যার নাম উল্লেখ করতে হয় তিনি হলেন, শায়খুল আরব ওয়াল আজম, আওলাদে রাসুল সা., যুগশ্রেষ্ঠ ও বিশ্ববরেণ্য  মুহাদ্দিস, জ্ঞান ও তাকওয়ার অনন্য প্রতীক, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অকুতোভয় সিপাহসালার, মুজাহিদে মিল্লাত, শায়খুল ইসলাম হযরত আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানীর (রাহ.)। অধ্যয়নরত অবস্থায়ই তিনি হযরত মাদাীর হাতে বায়আত গ্রহণ করে খেলাফতপ্রাপ্তির সৌভাগ্য অর্জন করেন।

দারুল উলুম অপরাপর উস্তাদগণ হলেন, হযরত মাওলানা ইব্্রাহিম বলিয়াভী (রাহ.), হযরত মাওলানা ফখরুল হাসান (রাহ.), তিরমিযী ও আবু দাউদ শরীফের উস্তাদ শয়খুল আদব মাওলানা ই’জাজ আলী  রাহ.), নাসাঈ শরীফের উস্তাদ হযরত মাওলানা ফখরুল হাসান (রাহ.), মুসলিম শরীফের উস্তাদ হযরত মাওলানা ইবরাহীম বলিয়াভী (রাহ.), তাহাভী শরীফের উস্তাদ হযরত মাওলানা জহিরুল হাসান (রাহ.), মুয়াত্তা মালেকের উস্তাদ হযরত মাওলানা জলিল আহমদ (রাহ.)।

ইলম, আমল আধ্যাত্মিকতায় ধন্য এই মনীষী একাধারে ৪ বছর বিরামহীন অধ্যয়ন ও বিশ্ববিখ্যাত আসাতিযায়ে কেরামের খেদমত ও তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণের মাধ্যমে হাদিস, তাফসীর, ফিক্হশাস্ত্রসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে পান্ডিত্য অর্জন যুগের অন্যতম শীর্ষ মুহাদ্দিস আল্লামা মাদানীর ইলমী ও আমলী প্রতিনিধি হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও দারুল উলুম হাটহাজারীতে শিক্ষকতা

দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর হযরত তাঁর পরম হিতাকাক্সক্ষী উস্তাদ দারূল উলূম হাটহাজারীর তৎকালীন মুহতামিম আল্লামা শাহ আবদুল ওয়াহহাব (রাহ,) এর সাথে সাক্ষাত করেন। আল্লামা আবদুল ওয়াহহাব তাঁর চরিত্র মাধুরী, গুণাবলি, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, পান্ডিত্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি উৎকৃষ্ট বোধশক্তি, সততা, উদারতা, আত্মত্যাগের মানসিকতা, ইখলাস, কর্তব্যনিষ্ঠা, দায়িত্বসচেতনতা সর্বোপরি ইলমের গভীরতা অবলোকন করে খুবই প্রীত ও বিমোহিত হন। ফলে তিনি প্রিয় শিষ্যকে জামিয়ার শিক্ষক পদে নিয়োগ দেন। আল্লাহপ্রেমের লক্ষ্যপানে অবিশ্রান্ত ছুটে চলা অভিযাত্রী, চিরপ্রত্যয়ী, মননশীল এ তরুণ আলিম এ জামিয়া থেকে তাঁর অধ্যাপনার কথা পুরো জামিয়া ছড়িয়ে পড়ে অল্পদিনের মধ্যেই। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ইলমের তৃষ্ণার্ত সন্ধানী মৌমাছিরা ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসে জামিয়ায়। পাশাপশি তিনি নবী আদর্শের প্রতিচ্ছবিরুপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারার ফলেই নানা শ্রেণী-পেশা মানুষ আত্মশুদ্ধি ও আত্মিক উন্নয়নের তৃষ্ণা নিবারণে তাঁর কাছে ছুটে আসে সবসময়।

জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুইনুল ইসলাম হাটহাজারীর পরিচালক

১৪০৭ হিজরী সালে তদানীন্তন জামিয়ার মুহতামিম আল্লামা হামেদ ৯রাহ.) পরলোক গমন করলে জামিয়ার সর্বোচ্চ মজলিসে শুরার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জামিয়া পরিচালনার গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয় বর্তমান মুহতামিম আল্লামা শাহ আহমদ শফীর উপর। হযরতের দক্ষতাপূর্ণ পরিচালনায় এ পর্যন্ত জামিয়া আহলিয়া হাটহাজারীর ইলমী, আমলী, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রভূতি উন্নতি সাধিত হয়। বর্তমানে তিনি পরিচালকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি জামিয়ার শায়খুল হাদিসেরও দায়িত্ব আঞ্জাম দিচ্ছেন। দারুল উলুম মুইনুল ইসলাম হাটহাজারী তাঁর আমলেই ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।
ঘযরতের সফল উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় দারুল উলূমের ব্যাপক সম্প্রসারণ ও সংস্কারের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ছাত্রদের আবাসন সঙ্কট নিরসনকল্পে বহু আবাসিক ছাত্রাবাস ভবন, দারুল হাদিস সম্প্রসারণ, জামিয়ার উত্তর পাশে তিন তলা বিশিষ্ট নতুর জামে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। রেলওয়ে থেকে পরিত্যক্ত ভূমি স্থায়ী লিজ নিয়ে সেখানে নির্মিত হয়েছে ৬ তলা বিশিষ্ট দু’টি আবাসিক স্টাফ কোয়ার্টার ভবন।

১৯৯৫ সালে জামিয়ার শতবর্ষ পূর্তি উদযাপন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয় ’শতবার্ষিকী দস্তারবন্দী মহসম্মেল’ বা সমাবর্তন অনুষ্ঠান। এ সম্মেলনে দেশ-বিদেশের ১০ হাজারের বেশি প্রাক্তণ ছাত্র অংশ গ্রহণ করে যাদের দস্তারে ফজিলত প্রদান করা হয়। ২০০২ সালে হযরতের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয় সপ্তবার্ষিকী মহাসম্মেলন। বর্তমানে জামিয়ার বার্ষিক মাহফিলে দস্তাবন্দী সম্মেলন তথা সমাবর্তনও অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টা ও আগ্রহে জামিয়ায় কিরাত, তাজভীদ, তাহফীজ, উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগের পাশাপাশি আরবি সাহিত্য বিভাগ, বাংলা সাহিত্য ও গবেষণা বিভাগ, কম্পিউটার, ছাত্রপাঠাগার, জামিয়ার মুখপত্র মাসিক মুইনুল ইসলাম-এর নিয়মিত প্রকাশনা, ইসলামি আইন পরিষদ, সাহিত্য পরিষদ, ফাতাওয়া বিভাগ ইত্যাদি সুন্দররূপে ও গতিশীলতার সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে।

সামাজিক আন্দোলন ও ধর্মীয় তৎপরতা

অন্যদিকে সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে ইসলামি আদর্শ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি ব্যাপক কর্মকা-ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। শায়খুই ইসলাম হয়রত হুসাইন আহমদ মাদানীর এই আধ্যাত্মিক শিষ্য স্বীয় ও পীর উস্তাদের আদর্শে অনুপ্রানিত হয়ে ইসলামি আকীদ-বিশ্বাস, তাহজীব-তামাদ্দুন, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও আদর্শ বাস্তবায়নে যে কোন বাস্তব কর্মসূচিতে তিনি সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত ও সাড়া জাগানো অরাজনৈতিক, আধ্যাত্মিক সংগঠন ’হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’ এর আমীর। নাস্তিক-বিরোধী মাত্র দেড় মাসর আন্দোলনে যে সংগঠন গোটা বাংলাদেশের লাখো-কোটি তাওহীদি জনতাকে এক কাতারে নিয়ে এসেছে। দেশব্যাপী নবীপ্রেমিক জনতার মহাজাগরণ সৃষ্টি করেছে আল্লাহর অসীম রহমত ও অপরিমেয় সাহায্যের ফলে। এই পুস্তকের পরিশিষ্টে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আন্দোলন ও কর্মতৎপরতা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হবে বিধায় এখানে সে বিষয়ে আলোচনা থেকে বিরত রইলাম।
তিনি বাংলাদেশের হক্কানী ওলামায়ে কেরামের নেতৃত্বধানী বিশুদ্দ আকীদার সকল ইসলামি সংগঠনের অভিভাবকত্ব করে যাচ্ছেন। তিনিই যেন সকলের সমন্বয়স্থল। বিভিন্ন ইসলামি দলের নেতৃবৃন্দ যেকোনো সমস্যায় হযরতের কাছে ছুটে আসেন। 

হযরতের শিষ্য ও দেশ-বিদেশের সম্মাননা

বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, লন্ডন, দুবাই, কাতার, বাহরাইন, কয়েতসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ও উপমাহদেশের বহু জায়গায় তাঁর ছাত্র-শিষ্য, মুরিদ অনুসারী ছড়িয়ে আছে। বিশেষত, আরবদেশগুলোতে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা ঈর্ষণীয়। তাঁর ন¤্রতা, তাকওয়া, ইলম, প্রজ্ঞা প্রত্যক্ষ করে স্বয়ং হারাম শরীফের ইমামগণ তাঁকে (আরবের সবচেয়ে সম্মানসূচক শব্দ) ’শায়খ’ শব্দে সম্বোধন করে থাকেন। ১৯ আগস্ট ২০০১ সালে লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পথে পবিত্র ওমরা পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব গমন করলে হারামাইন শরীফাইনের মহাপরিচালক শায়খ সালেহ বিন আল হুমাইদ এর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের এক পর্যায়ে তিনি হযরতকে কা’বা শরীফের গেলাফের একটি অংশ উপহার দিয়ে সম্মনিত করেন।

বাংলাদেশ জাতীয় সীরাত কমিটি ২০০৫ সালে তাকে ’শ্রেষ্ঠ ইসলামি ব্যক্তিত্ব’ ঘোষণা করে স্বর্ণপদক প্রদান করে।

সূযের আলোকরশ্মি যেরূপ বিশ্ববাসীকে পথ দেখায়, তেমনই একজন আশলসম্পন্ন প্রকৃত আলিম, নায়েবে রাসূল সা. বিশ্বের মানুষকে আলোর পথ ও সত্যের পথ দেখাতে সক্ষম। মুসলিম উম্মাহর এই ত্যাগী সংগ্রামী ও বিপ্লবী সমাজসংস্কারক আজীবন শিরক-বিদআত, কবর পূজা, মাজার পূজা, তথা সকল কুসংস্কার উচ্ছেদের ক্ষেত্রে সদা জাগ্রত। হযরতের আবেগঘন, জ্বালাময়ী ও সারগর্ভ উপস্থাপনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। তাঁর তথ্যবহুল, বিশ্লেষণধর্মী ও যু্িক্তপূর্ণ বয়ান, ভাষণ ইত্যাদির ফলে লাখ লাখ মানুষ ভ্রষ্টাচার ও ভ্রান্তপথ ছেড়ে ঈমান ও আমলের আলোকিত পথে উঠে আসছেন- আলহামদুলিল্লাহ।

আধ্যাত্মিকতা

কর্মময় জীবনের হাজারো ব্যস্ততা স্বত্বেও সময় ও নিয়মানুবর্তিতা হযরতের জীবনধারার এক অবিচ্ছেদ অংশ। দিন-রাতের মূল্যবান সময়কে নির্দিষ্ট রুটিনে ভাগ করে অধ্যাপনা, অধ্যয়ন, মাদ্রাসা পরিচালনা, ইবাদত-বন্দেগী, জিকির-আজকার, সাক্ষাৎপ্রার্থী ও শুভার্থীদের সাক্ষাৎ দেয়া ইত্যাদি সম্পন্ন করেন। গভীর রজনীতে মানুষ যখন গভীর নিদ্রায় বিভোর তখন তিনি দাঁড়িযে যান তাহাজ্জুদ নামাজে। একান্ত-নিভৃতে আদায় করে বিভিন্ন অজিফ। অশ্রুবিগলিত কন্ঠে, কায়মনোবাক্যে দোয়া করেন দেশ, জাতি, সমাজ-রাষ্ট্র ও গোটা মুসলিম উম্মাহ সর্বোপরি মানবতার জন্যে।


লেখক, গবেষক ও গ্রন্থাকার আল্লামা আহমদ শফী

দারস-অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি লেখালেখি ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণে কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রেখে চরেছেন। ঈমান, আকীদা, আত্মশুদ্ধি, দাওয়াত, জিহাদ, ইসলামি শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতিসহ বহু বিষয়ে তিনি গ্রন্থ রচনা করে একদিকে তাঁর গবেষণালব্ধ জ্ঞান মানুষের মাঝে সাবলিল ভাষায় উপস্থাপন করেছেন অন্যদিকে মিথ্যা, বিকৃত ও ভ্রান্ত আকিদা-বিশ্বাস সম্পর্কে সাধারণ মুসলমানেদের চোখ খুলে দিয়েছেন।

তার রচিত গ্রন্থাবলির মধ্যে অন্যতম হল-
১. হক বাতিলের চিরন্তর দ্বন্ধ
২. ইসলামী অর্থব্যবস্থা
৩. ইসলাম ও রাজনীতি
৪. ইজহারে হাকিকত বা বাস্তব দৃষ্টিতে মওদুদী মতবাদ
৫. তাকফীরে মুসলিম বা মুসলমানকে কাফির বলার পরিণাম
৬. সত্যের দিকে করুণ আহবান
৭. একটি সন্দেহের অবসান
৮. একটি গুরুত্বপূর্ণ ফতোয়া
৯. তাবলীগ অন্যতম জিহাদ
১০. ইছমতে আম্বিয়া ও মি’ইয়ারে হক
১১. বায়আতের হাকিকত প্রভৃতি।





পরিশিষ্ট: হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এর আমীর আল্লামা আহমদ শফী

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ একটি সামাজিক, আধ্যাত্মিক ও আত্মসংশোধনমূলক সংগঠন। মূলত, এটি সবৃজনীন অরাজনৈতিক একটি প্লাটফরম। মুসলমানদের ঈমান-আক্বীদা, সভ্যতা-সংস্কৃতি, ইসলামের বিধান ও প্রতীকসমূহের হেফাজত সম্পর্কে মুসলমানদের সচেতন করে তোলা এবং ধর্মীয় ইস্যুতে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দেলন অব্যাহত রাখা হেফাজত ইসলামের প্রধান লক্ষ্য।

হেফাজতে ইসলাম মুসলমানদের ঈমান-আক্বীদা ও তাহযীব-তামাদ্দুন সংরক্ষণে সর্বাত্মক ও নিরাপস ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্যে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচি পরিচালিত হয় না। কারো সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক স্বার্থভিত্তিক বন্ধুত্ব বা শত্রুতা নেই। কিন্তু রাজনৈতিক ইস্যুর আড়ালে ইসলামকে টার্গেট করা হচ্ছে বিধায় দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে হেফাজতে ইসলাম সর্বস্তরের মু’মিন –মুসলমান তথা নবীপ্রেমিক, ইসলামপ্রিয় জনতাকে  সঙ্গে নিয়ে কিচু কর্মসূটি ঘোষণা করেছে। মহান আল্লাহ তা’য়ালা, রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম, ইসলামের বিধান ও প্রতীকসমূহের ওপর কাফের-মুশরিক, ইয়াহুদি-নাসারা ও তাদের দোসরদের আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করা সময়ের অপরিহার্য দাবি। উম্মতে মুসলিমার সঙ্কটকালে আকাবেরীন ওলামায়ে দেওবন্দ যেভাবে কুরবানী ও ত্যাগের নজরানা পেশ করেছিলেন তা আমাদের জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁদের অনুসারী হিসেবে আমরা প্রত্যেকে দীনের মুজাহিদ হিসেবে নিজেকে আল্লাহর রাস্তায় পেশ করতে হবে।

শতকরা নব্বই শাতাংশ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশ। এদেশ হাজার হাজার আলিমা-ওলামা, পীর-বুজর্গ, মুহাদ্দি-মুফাস্সির, মুফতি, অলি-আউলিয়ার জন্মভূমি। যাঁদের পদচারণায় বাংলার মাটি ইসলামের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এ মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে, ইমামুল হিন্দ শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহদ্দিসে দেহলভী রাহ. এর উত্তরসূরি, হুজ্জাতুল ইসলাম কাসম নানুতুভী রাহ., ফকীহুল হিন্দ রশীদ আহমদ গঙ্গুহী রাহ. ও শায়খুল ইসলাম সাইয়েদ হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ. এর লাখো রূহানী সন্তান। এ ঐতিহাসিক বাস্তবতার কারণেই এ মাটির গভীরে প্রোথিত আছে ইসলামের বিস্তৃত শিকড়। আজ সেই বাংলাদেশ থেকে ইসলামকে সমূলে উৎখাতের হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী ও ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী গোষ্ঠী এবং তাদের এদেশীয় এজেন্ট মুসলিম নামধারী কিছু নাস্তিক মুরতাদ ও তাসলিমা নাসরিনের ভাবশিষ্য বামপন্থী ব্লগাররা। যারা আল্লাহ, রাসুল, ইসলামের প্রতীকসমূহের ওপর আক্রমণের দিক থেকে ইতোমধ্যেই তাসলিমা নাসরিনসহ তাদের সকল পূর্বসূরী নাস্তিক এমনকি ইয়াহুদি স্যামবাসিলকেও ছাড়িয়ে গেছে।
আল্লাহ-রাসুল সা., উম্মাহাতুল মু’মিনীন, সাহাবায়ে কেরাম ও ইসলামের মৌলিক বিধান সমূহের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছে। শুধু তাই নয়, বামপন্থী নাস্তিক বুদ্ধিজীবিদের পরামর্শে বর্তমান সরকার এ দেশ থেকে ইসলাম বিতাড়নের দীর্ঘমেয়াদী নীল নকশা বাস্তবায়ন শুরু করেছে। কতিপয় প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া  তাদের বলিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে প্রতিনিয়ত ইসলাম, মুসলমান ও আলিম-ওলঅমাদের হেয়প্রতিপন্ন করার হীন চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। তারা আলিম-ওলামা ও মাদানিসে দীনিয়্যার বিরুদ্ধে হরদম মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্তিকর সংবাদ পরিবেশন করে জাতিকে বিভক্ত করার অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। আযাদী আন্দোলনের দুর্দান্ত সিপাহসালার শায়খুল ইসলাম আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানীর (রাহ.) সুযোগ্য উত্তরসূরি দলমত-শ্রেণীগোষ্ঠী নির্বিশেষে ঈমান, আকীদা, ইসলামের প্রতীক, বিধান, তাহযীব-তামাদ্দুন সমুন্নত রাখার প্রত্যয়ে ঈমানী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এই আন্দোলনে সর্বত্র অভাবনীয় সাড়া জেগেছে। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, রুপসা থেকে পাথুরিয়া নবীপ্রেমিক জনতার এই মহাজাগরণ আল্লামা আহমদ শফীর ইখলাস, নিষ্ঠা, লিল্লাহিয়্যাত ও ঈমানীশক্তির বরকতের ফসল। হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে আল্লামা শাহ আহমদ শফী যে কর্মসূচি দিচ্ছেন সবখানেই বিস্ময়করভাবে আল্লাহর সাহায্য পরিদৃষ্ট হচ্ছে আলহামদুলিল্লাহ।
আল্লামা আহমদে শফী'র "জীবন ও র্কম"

সৃষ্টির সূচনাকাল থেকেই আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত মানবজাতিকে সত্য, সুন্দর কল্যাণ ও মুক্তির আলোকিত তুলে আনার জন্য ওয়াজ-নসিহত, শিক্ষা ও তরবিয়্যতের মিশনে নিয়োজিত থেকেছেন নবী-রাসূলের উত্তরসূরি আলিম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ, অলি-আউলিয়া। বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন :
’(হে মুহাম্মদ সা.) আপনি (মানবজাতিকে) হিকমাত ও সুন্দর উপদেশ প্রদানের মাধ্যমে আপনার প্রভুর পথে আহবান করুন।’
আল্লাহ প্রদত্ত এ দায়িত্ব পালনকে জীবনের প্রধান লক্ষ্যরুপে নির্ধারণ করেছেন এবং উদ্দেশ্যকে সফল করতে পার্থিব সম্পদ-ঐশ্বর্য, সুখ-স্বাচ্ছন্দ ও যাবতীয় লোভ-লালসা, ভয়ভীতি, তিরস্কার-ভৎর্সনা উপেক্ষা করে হকের দাওয়াতী মশাল প্রজ্জ্বলিত রেখেছেন। কেয়ামত পর্যন্ত ইনশা’আল্লাহ এই প্রদীপ আলো ছড়াবে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেছেন,
’আমার উম্মতের একটি দল সর্বাবস্থায় সত্যেও ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, শত্রুরা তাদেও কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’
সুতরাং কোনো শতাব্দী, কোনো যুগ সত্যপন্থী এই পবিত্র দলের তৎপরতাবিহীন থাকবে না। প্রত্যেক যুগের এদেও একটি কাফেলা থাকবে; যারা ইসলামের প্রচার, উপস্থাপন ও আল্লাহর বাণীকে সর্বোচ্চে তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা অব্যাহত রাখবে। আল্লাহর পথের দাঈ ও রাসূলের আদর্শেও পতাকাবাহী দীনের এই সৈনিকরা পৃথিবীর মহামূল্যবান সম্পদ। জনসমাজে, ইতিহাসের পাতায় ও মানুষের হৃদয়ে তারা চিরদিন রাজত্ব করেন, ইহজগত থেকে শারীরিকভাবে লোকান্তরিত হয়েও জগতে তাঁরা বেঁচে থাকেন চিরকাল।

উপমাহাদেশের এমন ক্ষণজন্ম মহাপুরুষদের অন্যতম হলেন, দেশবরেণ্য আলিমেদীন, অলিয়ে কামেল, শায়খুল ইসলাম হযরত আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানীর (রাহ.) অন্যতম খলিফা, দেশের প্রাচীন ও বৃহৎ দীনি দরসেগাহ জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীর মুহতামিম, শায়খুল আল্লামা শাহ আহমদ শফী। যার কৈশৌর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব আর বার্ধক্য ইলম, আমল, ইখলাস (আত্মশুদ্ধি), দাওয়াতের পূণ্যময় আলোয় উদ্ভাসিত। গোটা জাতির অবিসংবাদিত এই আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক একাধারে মেধাবী আলিম, সফল শিক্ষক, পরিশুদ্ধ সাধক, দূরদর্শী সমাজসংস্কারক, সংযমী, বিনয়ী, সদালাপী, মিষ্টভাষী, যু্ক্তিবাদী, উদার ও পরম স্নেহবৎসল এক জ্যোর্তিময় ব্যক্তিত্ব।
পঙ্কিলতার আবর্তে ডুবে যাওয়া সমাজে আত্মশুদ্ধির মঞ্চে শুদ্ধতার ছড়ি হাতে এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্বের ধীর অথচ দৃঢ় কদমে অগ্রসরমান এক শান্ত-সমাহিত ব্যক্তিত্বের আলেখ্য পাঠকের হাতে তুলে দিতে চাই। ভক্তপ্রাণের হৃদয়নদে দু’কুল ছাপিয়ে বহমান অঢেল প্রশান্তির শূর্তপ্রতীক শ্বেতশুভ্র পোষাকে অনিন্দ্যসুন্দর এক অসাধারণ মানুষের কাহিনী হয়রত আল্লামা শাহ আহমদ শফী সাহেব (দা.বা.) এই সংক্ষিপ্ত ’জীবন কথা’।


জন্ম, বেড়ে ওঠা শিক্ষা-দীক্ষা পর্ব

১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ১৩৫১ হিজরী সালে বার আউলিয়ার পূর্ণভুমি বীর চট্টলার রাঙ্গুনিয়া থানাধীন পাখিয়ার টিলা নামক গ্রামে এক অভিজাত, সম্ভ্রান্ত ও ঐতিহ্যবাহী দীনদান পরিবারে আল্লামা শাহ আহমদ শফীর জন্ম। তাঁর ভাগ্যবান পিতা জনাব বরকত আলী ও রতœগর্ভা মাতা মেহেরুন নেসা বেগম। নবজাতক আহমদ শফীর জন্মের পর মা-বাবা তাদের নয়নমনি, প্রিয় সন্তানকে মুসলিম উম্মাহর পথনির্দেশক হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন বুনতে থাকেন। মহান আল্লাহ, তাঁদের এ মহৎ স্বপ্ন অপূর্ণ রাখেননি। শৈশবে তাঁর পিতা-মাতা শিশু আহমদ শফীকে পবিত্র কুরআন শিক্ষা দেবার মৌলভী আজিজুর রহমানের কাছে প্রেরণ করেন। সমান্তরালে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গেই চতুর্থ শ্রেণী পর্যনত্ সাধারণ শিক্ষার পাঠক্রম সম্পন্ন করেন। এরপর সরফভাটা মাদ্রাসায় প্রাথমিক কিতাবাদি অধ্যয়ন শুরু করেন। ছোট বেলা থেকেই অত্যন্ত ন¤্র, বিনয়ী, চিন্তাশীল, প্রখর মেধাবী, তীক্ষèধীরশক্তির, অধিকারী হওয়া বয়সেই তিনি কুরআনের কারিমের নাজার, প্রাথমিক শিক্ষাস্তর কৃতিত্বের সঙ্গে সমাপ্ত করেন। অতঃপর কিশোর আহমদ শফী মাধ্যমিক স্তরের পড়ালেখার উদ্দেশ্যে দক্ষিণ চট্টগ্রামের এতিহ্যবাহী প্রাচীর ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আল-জামিয়া আল আরবিয়া জিরি-তে ভর্তি হন। সেখানে ৫/৬ মাস অধ্যয়ন করার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঢংকা বেজে উঠার পরিপ্রেক্ষিতে ১৩৬১ হিজরীতে তাাঁর শ্রদ্ধাস্পদ হিতাকাক্সক্ষী হাফেজ ইমতিয়াজের প্রচেষ্টায় এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম হাটহাজারীতে ভর্তি হন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১০ বছর। দশ বছরের বালক আহমদ শফীকে এ বয়সেই শোক সাগরে ভাসিয়ে মাতা-পিতা দু’জন পরপর ইন্তেকালা করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)।

দারুল উলূম হাটহাজারীতে তিনি টানা দশ বছর আত্মত্যাগ, কঠোর ধৈর্য, সদাচার, লেখাপড়ায় গভীর অভিনিবেশ ইত্যাদি গুণাবলির কারণে উস্তাদমহলের বিশেষ স্নেহভাজন ছাত্রে পরিণত হন। এখানে এক দশক অতিক্রান্ত হল। সম-সাময়িক বিজ্ঞ আলিমদের স্নেহধন্য সান্নিধ্যে থেকে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের দক্ষ উস্তাদদের প্রত্যক্ষ তত্ত্ববধানে আরবি সাহিত্য, ব্যাকরণ, নাহু-সরফ, ইলমে ফিকহ, মানতিক (যুক্তিবিদ্যা), দর্শন, বালাগাত (আরবী ভাষার অলঙ্কারশাস্ত্র) প্রভৃতি বিষয়ে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।

দারুল উলূম মুইনুল ইসলাম হাটহাজারীতে তিনি দেশের শীর্ষ আলিম ও বুজর্গ ব্যক্তিত্বগণের কাছে সরাসরি শিক্ষাগ্রহণের সৌভাজ্য অর্জন করেরন। তাঁর উস্তাদগণের মধ্যে খ্যাতিমান আলিমেদীন, সমাজসংস্কারক, উপমহাদেশের প্রখ্যাত আইনবিশারদ আল্লামা মুফতিয়ে আযম হযরত মাওলানা ফয়েজুল্লাহ (রাহ.), শায়খুল হাদিস আল্লামা সুফী আবদুল কাইয়ুম (রাহ.), শায়খুল আদব আল্লামা মুহাম্মদ আলী নিজামপুরী (রাহ.) ও আল্লামা শায়খ আবুল হাসান (রাহ.) এর নাম প্রণিধানযোগ্য।


উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে দারুল উলূম দেওবন্দ যাত্রা

নবীপ্রেমিক এই বুজর্গের বল্যকাল, প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষার সময়-প্রবাহ ছিল, বৈচিত্রময় ও চাঞ্চল্যকর ঘটনায় পূর্ণ। ১৩৭১ হিজরী সালে তিনি উচ্চ শিক্ষার অদম্য আগ্রহ ও জ্ঞানার্জনের প্রবল তৃষ্ণা নিয়ে ছুটে যান উপমহাদেশের বৃহত্তম ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্র, ঐতিহ্যবাহী হাদিস শিক্ষার পাদপীঠ, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যতম সূতিকার দারুল উলূম দেওবন্দে। দারুল উলূম দেওবন্দে তিনি হাদিস, তাফসীর প্রভৃতি উচ্চতর বিশেষায়িত কোর্স সম্পন্ন করেন। দারুল উলূম দেওবন্দে অধ্যয়নকালে তিনি যাঁদের সংশ্রব লাভে করেন তাদের সর্বাগ্রে যার নাম উল্লেখ করতে হয় তিনি হলেন, শায়খুল আরব ওয়াল আজম, আওলাদে রাসুল সা., যুগশ্রেষ্ঠ ও বিশ্ববরেণ্য মুহাদ্দিস, জ্ঞান ও তাকওয়ার অনন্য প্রতীক, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অকুতোভয় সিপাহসালার, মুজাহিদে মিল্লাত, শায়খুল ইসলাম হযরত আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানীর (রাহ.)। অধ্যয়নরত অবস্থায়ই তিনি হযরত মাদাীর হাতে বায়আত গ্রহণ করে খেলাফতপ্রাপ্তির সৌভাগ্য অর্জন করেন।

দারুল উলুম অপরাপর উস্তাদগণ হলেন, হযরত মাওলানা ইব্্রাহিম বলিয়াভী (রাহ.), হযরত মাওলানা ফখরুল হাসান (রাহ.), তিরমিযী ও আবু দাউদ শরীফের উস্তাদ শয়খুল আদব মাওলানা ই’জাজ আলী রাহ.), নাসাঈ শরীফের উস্তাদ হযরত মাওলানা ফখরুল হাসান (রাহ.), মুসলিম শরীফের উস্তাদ হযরত মাওলানা ইবরাহীম বলিয়াভী (রাহ.), তাহাভী শরীফের উস্তাদ হযরত মাওলানা জহিরুল হাসান (রাহ.), মুয়াত্তা মালেকের উস্তাদ হযরত মাওলানা জলিল আহমদ (রাহ.)।

ইলম, আমল আধ্যাত্মিকতায় ধন্য এই মনীষী একাধারে ৪ বছর বিরামহীন অধ্যয়ন ও বিশ্ববিখ্যাত আসাতিযায়ে কেরামের খেদমত ও তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণের মাধ্যমে হাদিস, তাফসীর, ফিক্হশাস্ত্রসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে পান্ডিত্য অর্জন যুগের অন্যতম শীর্ষ মুহাদ্দিস আল্লামা মাদানীর ইলমী ও আমলী প্রতিনিধি হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন।

স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও দারুল উলুম হাটহাজারীতে শিক্ষকতা

দারুল উলূম দেওবন্দ থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর হযরত তাঁর পরম হিতাকাক্সক্ষী উস্তাদ দারূল উলূম হাটহাজারীর তৎকালীন মুহতামিম আল্লামা শাহ আবদুল ওয়াহহাব (রাহ,) এর সাথে সাক্ষাত করেন। আল্লামা আবদুল ওয়াহহাব তাঁর চরিত্র মাধুরী, গুণাবলি, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, পান্ডিত্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি উৎকৃষ্ট বোধশক্তি, সততা, উদারতা, আত্মত্যাগের মানসিকতা, ইখলাস, কর্তব্যনিষ্ঠা, দায়িত্বসচেতনতা সর্বোপরি ইলমের গভীরতা অবলোকন করে খুবই প্রীত ও বিমোহিত হন। ফলে তিনি প্রিয় শিষ্যকে জামিয়ার শিক্ষক পদে নিয়োগ দেন। আল্লাহপ্রেমের লক্ষ্যপানে অবিশ্রান্ত ছুটে চলা অভিযাত্রী, চিরপ্রত্যয়ী, মননশীল এ তরুণ আলিম এ জামিয়া থেকে তাঁর অধ্যাপনার কথা পুরো জামিয়া ছড়িয়ে পড়ে অল্পদিনের মধ্যেই। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ইলমের তৃষ্ণার্ত সন্ধানী মৌমাছিরা ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসে জামিয়ায়। পাশাপশি তিনি নবী আদর্শের প্রতিচ্ছবিরুপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারার ফলেই নানা শ্রেণী-পেশা মানুষ আত্মশুদ্ধি ও আত্মিক উন্নয়নের তৃষ্ণা নিবারণে তাঁর কাছে ছুটে আসে সবসময়।

জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুইনুল ইসলাম হাটহাজারীর পরিচালক

১৪০৭ হিজরী সালে তদানীন্তন জামিয়ার মুহতামিম আল্লামা হামেদ ৯রাহ.) পরলোক গমন করলে জামিয়ার সর্বোচ্চ মজলিসে শুরার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জামিয়া পরিচালনার গুরুদায়িত্ব অর্পিত হয় বর্তমান মুহতামিম আল্লামা শাহ আহমদ শফীর উপর। হযরতের দক্ষতাপূর্ণ পরিচালনায় এ পর্যন্ত জামিয়া আহলিয়া হাটহাজারীর ইলমী, আমলী, প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রভূতি উন্নতি সাধিত হয়। বর্তমানে তিনি পরিচালকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি জামিয়ার শায়খুল হাদিসেরও দায়িত্ব আঞ্জাম দিচ্ছেন। দারুল উলুম মুইনুল ইসলাম হাটহাজারী তাঁর আমলেই ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।
ঘযরতের সফল উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় দারুল উলূমের ব্যাপক সম্প্রসারণ ও সংস্কারের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ছাত্রদের আবাসন সঙ্কট নিরসনকল্পে বহু আবাসিক ছাত্রাবাস ভবন, দারুল হাদিস সম্প্রসারণ, জামিয়ার উত্তর পাশে তিন তলা বিশিষ্ট নতুর জামে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। রেলওয়ে থেকে পরিত্যক্ত ভূমি স্থায়ী লিজ নিয়ে সেখানে নির্মিত হয়েছে ৬ তলা বিশিষ্ট দু’টি আবাসিক স্টাফ কোয়ার্টার ভবন।

১৯৯৫ সালে জামিয়ার শতবর্ষ পূর্তি উদযাপন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয় ’শতবার্ষিকী দস্তারবন্দী মহসম্মেল’ বা সমাবর্তন অনুষ্ঠান। এ সম্মেলনে দেশ-বিদেশের ১০ হাজারের বেশি প্রাক্তণ ছাত্র অংশ গ্রহণ করে যাদের দস্তারে ফজিলত প্রদান করা হয়। ২০০২ সালে হযরতের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠিত হয় সপ্তবার্ষিকী মহাসম্মেলন। বর্তমানে জামিয়ার বার্ষিক মাহফিলে দস্তাবন্দী সম্মেলন তথা সমাবর্তনও অনুষ্ঠিত হয়। তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টা ও আগ্রহে জামিয়ায় কিরাত, তাজভীদ, তাহফীজ, উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগের পাশাপাশি আরবি সাহিত্য বিভাগ, বাংলা সাহিত্য ও গবেষণা বিভাগ, কম্পিউটার, ছাত্রপাঠাগার, জামিয়ার মুখপত্র মাসিক মুইনুল ইসলাম-এর নিয়মিত প্রকাশনা, ইসলামি আইন পরিষদ, সাহিত্য পরিষদ, ফাতাওয়া বিভাগ ইত্যাদি সুন্দররূপে ও গতিশীলতার সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে।

সামাজিক আন্দোলন ও ধর্মীয় তৎপরতা

অন্যদিকে সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে ইসলামি আদর্শ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি ব্যাপক কর্মকা-ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। শায়খুই ইসলাম হয়রত হুসাইন আহমদ মাদানীর এই আধ্যাত্মিক শিষ্য স্বীয় ও পীর উস্তাদের আদর্শে অনুপ্রানিত হয়ে ইসলামি আকীদ-বিশ্বাস, তাহজীব-তামাদ্দুন, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও আদর্শ বাস্তবায়নে যে কোন বাস্তব কর্মসূচিতে তিনি সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত ও সাড়া জাগানো অরাজনৈতিক, আধ্যাত্মিক সংগঠন ’হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’ এর আমীর। নাস্তিক-বিরোধী মাত্র দেড় মাসর আন্দোলনে যে সংগঠন গোটা বাংলাদেশের লাখো-কোটি তাওহীদি জনতাকে এক কাতারে নিয়ে এসেছে। দেশব্যাপী নবীপ্রেমিক জনতার মহাজাগরণ সৃষ্টি করেছে আল্লাহর অসীম রহমত ও অপরিমেয় সাহায্যের ফলে। এই পুস্তকের পরিশিষ্টে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আন্দোলন ও কর্মতৎপরতা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হবে বিধায় এখানে সে বিষয়ে আলোচনা থেকে বিরত রইলাম।
তিনি বাংলাদেশের হক্কানী ওলামায়ে কেরামের নেতৃত্বধানী বিশুদ্দ আকীদার সকল ইসলামি সংগঠনের অভিভাবকত্ব করে যাচ্ছেন। তিনিই যেন সকলের সমন্বয়স্থল। বিভিন্ন ইসলামি দলের নেতৃবৃন্দ যেকোনো সমস্যায় হযরতের কাছে ছুটে আসেন।

হযরতের শিষ্য ও দেশ-বিদেশের সম্মাননা

বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, লন্ডন, দুবাই, কাতার, বাহরাইন, কয়েতসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ও উপমাহদেশের বহু জায়গায় তাঁর ছাত্র-শিষ্য, মুরিদ অনুসারী ছড়িয়ে আছে। বিশেষত, আরবদেশগুলোতে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা ঈর্ষণীয়। তাঁর ন¤্রতা, তাকওয়া, ইলম, প্রজ্ঞা প্রত্যক্ষ করে স্বয়ং হারাম শরীফের ইমামগণ তাঁকে (আরবের সবচেয়ে সম্মানসূচক শব্দ) ’শায়খ’ শব্দে সম্বোধন করে থাকেন। ১৯ আগস্ট ২০০১ সালে লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পথে পবিত্র ওমরা পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব গমন করলে হারামাইন শরীফাইনের মহাপরিচালক শায়খ সালেহ বিন আল হুমাইদ এর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের এক পর্যায়ে তিনি হযরতকে কা’বা শরীফের গেলাফের একটি অংশ উপহার দিয়ে সম্মনিত করেন।

বাংলাদেশ জাতীয় সীরাত কমিটি ২০০৫ সালে তাকে ’শ্রেষ্ঠ ইসলামি ব্যক্তিত্ব’ ঘোষণা করে স্বর্ণপদক প্রদান করে।

সূযের আলোকরশ্মি যেরূপ বিশ্ববাসীকে পথ দেখায়, তেমনই একজন আশলসম্পন্ন প্রকৃত আলিম, নায়েবে রাসূল সা. বিশ্বের মানুষকে আলোর পথ ও সত্যের পথ দেখাতে সক্ষম। মুসলিম উম্মাহর এই ত্যাগী সংগ্রামী ও বিপ্লবী সমাজসংস্কারক আজীবন শিরক-বিদআত, কবর পূজা, মাজার পূজা, তথা সকল কুসংস্কার উচ্ছেদের ক্ষেত্রে সদা জাগ্রত। হযরতের আবেগঘন, জ্বালাময়ী ও সারগর্ভ উপস্থাপনা দেশজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। তাঁর তথ্যবহুল, বিশ্লেষণধর্মী ও যু্িক্তপূর্ণ বয়ান, ভাষণ ইত্যাদির ফলে লাখ লাখ মানুষ ভ্রষ্টাচার ও ভ্রান্তপথ ছেড়ে ঈমান ও আমলের আলোকিত পথে উঠে আসছেন- আলহামদুলিল্লাহ।

আধ্যাত্মিকতা

কর্মময় জীবনের হাজারো ব্যস্ততা স্বত্বেও সময় ও নিয়মানুবর্তিতা হযরতের জীবনধারার এক অবিচ্ছেদ অংশ। দিন-রাতের মূল্যবান সময়কে নির্দিষ্ট রুটিনে ভাগ করে অধ্যাপনা, অধ্যয়ন, মাদ্রাসা পরিচালনা, ইবাদত-বন্দেগী, জিকির-আজকার, সাক্ষাৎপ্রার্থী ও শুভার্থীদের সাক্ষাৎ দেয়া ইত্যাদি সম্পন্ন করেন। গভীর রজনীতে মানুষ যখন গভীর নিদ্রায় বিভোর তখন তিনি দাঁড়িযে যান তাহাজ্জুদ নামাজে। একান্ত-নিভৃতে আদায় করে বিভিন্ন অজিফ। অশ্রুবিগলিত কন্ঠে, কায়মনোবাক্যে দোয়া করেন দেশ, জাতি, সমাজ-রাষ্ট্র ও গোটা মুসলিম উম্মাহ সর্বোপরি মানবতার জন্যে।


লেখক, গবেষক ও গ্রন্থাকার আল্লামা আহমদ শফী

দারস-অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি লেখালেখি ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গণে কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রেখে চরেছেন। ঈমান, আকীদা, আত্মশুদ্ধি, দাওয়াত, জিহাদ, ইসলামি শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতিসহ বহু বিষয়ে তিনি গ্রন্থ রচনা করে একদিকে তাঁর গবেষণালব্ধ জ্ঞান মানুষের মাঝে সাবলিল ভাষায় উপস্থাপন করেছেন অন্যদিকে মিথ্যা, বিকৃত ও ভ্রান্ত আকিদা-বিশ্বাস সম্পর্কে সাধারণ মুসলমানেদের চোখ খুলে দিয়েছেন।

তার রচিত গ্রন্থাবলির মধ্যে অন্যতম হল-
১. হক বাতিলের চিরন্তর দ্বন্ধ
২. ইসলামী অর্থব্যবস্থা
৩. ইসলাম ও রাজনীতি
৪. ইজহারে হাকিকত বা বাস্তব দৃষ্টিতে মওদুদী মতবাদ
৫. তাকফীরে মুসলিম বা মুসলমানকে কাফির বলার পরিণাম
৬. সত্যের দিকে করুণ আহবান
৭. একটি সন্দেহের অবসান
৮. একটি গুরুত্বপূর্ণ ফতোয়া
৯. তাবলীগ অন্যতম জিহাদ
১০. ইছমতে আম্বিয়া ও মি’ইয়ারে হক
১১. বায়আতের হাকিকত প্রভৃতি।





পরিশিষ্ট: হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এর আমীর আল্লামা আহমদ শফী

হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ একটি সামাজিক, আধ্যাত্মিক ও আত্মসংশোধনমূলক সংগঠন। মূলত, এটি সবৃজনীন অরাজনৈতিক একটি প্লাটফরম। মুসলমানদের ঈমান-আক্বীদা, সভ্যতা-সংস্কৃতি, ইসলামের বিধান ও প্রতীকসমূহের হেফাজত সম্পর্কে মুসলমানদের সচেতন করে তোলা এবং ধর্মীয় ইস্যুতে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দেলন অব্যাহত রাখা হেফাজত ইসলামের প্রধান লক্ষ্য।

হেফাজতে ইসলাম মুসলমানদের ঈমান-আক্বীদা ও তাহযীব-তামাদ্দুন সংরক্ষণে সর্বাত্মক ও নিরাপস ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্যে হেফাজতে ইসলামের কর্মসূচি পরিচালিত হয় না। কারো সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক স্বার্থভিত্তিক বন্ধুত্ব বা শত্রুতা নেই। কিন্তু রাজনৈতিক ইস্যুর আড়ালে ইসলামকে টার্গেট করা হচ্ছে বিধায় দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে হেফাজতে ইসলাম সর্বস্তরের মু’মিন –মুসলমান তথা নবীপ্রেমিক, ইসলামপ্রিয় জনতাকে সঙ্গে নিয়ে কিচু কর্মসূটি ঘোষণা করেছে। মহান আল্লাহ তা’য়ালা, রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম, ইসলামের বিধান ও প্রতীকসমূহের ওপর কাফের-মুশরিক, ইয়াহুদি-নাসারা ও তাদের দোসরদের আলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন করা সময়ের অপরিহার্য দাবি। উম্মতে মুসলিমার সঙ্কটকালে আকাবেরীন ওলামায়ে দেওবন্দ যেভাবে কুরবানী ও ত্যাগের নজরানা পেশ করেছিলেন তা আমাদের জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাঁদের অনুসারী হিসেবে আমরা প্রত্যেকে দীনের মুজাহিদ হিসেবে নিজেকে আল্লাহর রাস্তায় পেশ করতে হবে।

শতকরা নব্বই শাতাংশ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশ। এদেশ হাজার হাজার আলিমা-ওলামা, পীর-বুজর্গ, মুহাদ্দি-মুফাস্সির, মুফতি, অলি-আউলিয়ার জন্মভূমি। যাঁদের পদচারণায় বাংলার মাটি ইসলামের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এ মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে, ইমামুল হিন্দ শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহদ্দিসে দেহলভী রাহ. এর উত্তরসূরি, হুজ্জাতুল ইসলাম কাসম নানুতুভী রাহ., ফকীহুল হিন্দ রশীদ আহমদ গঙ্গুহী রাহ. ও শায়খুল ইসলাম সাইয়েদ হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ. এর লাখো রূহানী সন্তান। এ ঐতিহাসিক বাস্তবতার কারণেই এ মাটির গভীরে প্রোথিত আছে ইসলামের বিস্তৃত শিকড়। আজ সেই বাংলাদেশ থেকে ইসলামকে সমূলে উৎখাতের হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী ও ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী গোষ্ঠী এবং তাদের এদেশীয় এজেন্ট মুসলিম নামধারী কিছু নাস্তিক মুরতাদ ও তাসলিমা নাসরিনের ভাবশিষ্য বামপন্থী ব্লগাররা। যারা আল্লাহ, রাসুল, ইসলামের প্রতীকসমূহের ওপর আক্রমণের দিক থেকে ইতোমধ্যেই তাসলিমা নাসরিনসহ তাদের সকল পূর্বসূরী নাস্তিক এমনকি ইয়াহুদি স্যামবাসিলকেও ছাড়িয়ে গেছে।
আল্লাহ-রাসুল সা., উম্মাহাতুল মু’মিনীন, সাহাবায়ে কেরাম ও ইসলামের মৌলিক বিধান সমূহের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছে। শুধু তাই নয়, বামপন্থী নাস্তিক বুদ্ধিজীবিদের পরামর্শে বর্তমান সরকার এ দেশ থেকে ইসলাম বিতাড়নের দীর্ঘমেয়াদী নীল নকশা বাস্তবায়ন শুরু করেছে। কতিপয় প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া তাদের বলিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে প্রতিনিয়ত ইসলাম, মুসলমান ও আলিম-ওলঅমাদের হেয়প্রতিপন্ন করার হীন চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। তারা আলিম-ওলামা ও মাদানিসে দীনিয়্যার বিরুদ্ধে হরদম মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও বিভ্রান্তিকর সংবাদ পরিবেশন করে জাতিকে বিভক্ত করার অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। আযাদী আন্দোলনের দুর্দান্ত সিপাহসালার শায়খুল ইসলাম আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানীর (রাহ.) সুযোগ্য উত্তরসূরি দলমত-শ্রেণীগোষ্ঠী নির্বিশেষে ঈমান, আকীদা, ইসলামের প্রতীক, বিধান, তাহযীব-তামাদ্দুন সমুন্নত রাখার প্রত্যয়ে ঈমানী আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এই আন্দোলনে সর্বত্র অভাবনীয় সাড়া জেগেছে। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, রুপসা থেকে পাথুরিয়া নবীপ্রেমিক জনতার এই মহাজাগরণ আল্লামা আহমদ শফীর ইখলাস, নিষ্ঠা, লিল্লাহিয়্যাত ও ঈমানীশক্তির বরকতের ফসল। হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে আল্লামা শাহ আহমদ শফী যে কর্মসূচি দিচ্ছেন সবখানেই বিস্ময়করভাবে আল্লাহর সাহায্য পরিদৃষ্ট হচ্ছে আলহামদুলিল্লাহ।