বেঁচে থাকার অবিশ্বাস্য গল্প

২৪ এপ্রিল বুধবার। অন্য আট-দশটি দিনের সঙ্গে এই দিনটির তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। বরাবরের মতোই সাভারের রানা প্লাজায় একাধিক গার্মেন্টের সব মেশিন সকাল সকালই সচল হয়ে ওঠে। আগের দিন ভবনে ফাটলের কারণে কেউ কেউ কাজে যোগ দিতে আপত্তি জানালেও কর্তৃপক্ষের কঠোরতায় তা ধোপে টেকেনি। কিন্তু কে জানত, এই দিনটিই জাতির ইতিহাসে বিভীষিকাময় একটা দিনে পরিণত হবে? সকাল পৌনে ৯টার দিকে সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ডের পাশের এই বহুতল ভবনটি মুহূর্তের মধ্যেই ধসে পড়ে। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০০ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকর্মীদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় প্রায় আড়াই হাজার মানুষকে জীবিত বের করে আনা হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ হাত হারিয়েছেন, কেউবা পা। কেউ আবার মারাত্দক আহত হয়েছেন। এরপরও তাদের বেঁচে থাকাটাকে নিজেরাই অলৌকিক মানছেন। এমন দুর্বিষহ পরিস্থিতি বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। সেই ধ্বংসস্তূপের মাঝখানেও তুমুল প্রতিকূল পরিবেশে বেঁচে থাকাটা সত্যি অবিশ্বাস্য। এমনই অবিশ্বাস্যভাবে বেঁচে যাওয়া ক'জনের রুদ্ধশ্বাস অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছেন_ জিন্নাতুন নূর, ছবি তুলেছেন_ জয়ীতা রায়





কোমরে লাশ নিয়ে ৪৮ ঘণ্টা কাটাই_ পাখি আক্তার

সাভার ট্র্যাজেডির নির্মমতার শিকার আরেক নারী শ্রমিক পাখি আক্তার (৩০)। পঞ্চম তলার এ শ্রমিক অসংখ্য মৃত মানুষের সঙ্গে প্রায় ৪৮ ঘণ্টা ভয়ঙ্কর সময় পার করেন। দুর্ঘটনার কারণে তার দুই পা কেটে উদ্ধার করতে হয়েছে। বর্তমানে অসহ্য ব্যথা নিয়ে কাতরাচ্ছেন এনাম মেডিকেল হাসপাতালে। আইসিসিইউতে চিকিৎসকরা সার্বক্ষণিক তার অবস্থার খোঁজ রাখছেন।

পাখি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, 'ভবন ভাইঙা যাওয়ার পর দুই দিন ধইরা দেয়ালের নিচে চাপা পইরা ছিলাম। সে সময় কোনো মানুষজন দেখতে পারি নাই। আমার আশপাশে সব লাশ থাকায় কেউ আমারে প্রথমে উদ্ধার করতে চায় নাই। ভাবছিল আমিও মনে হয় মইরা গেছি। জীবনের আশা এক সময় ছাইড়াই দিছিলাম। সে সময় শুধু আল্লাহর কাছে কাইনদা কাইনদা কইছি, আল্লাহ আমারে তুমি বাঁচাও।'

পাখি জানান, তার উরুর ওপর ভারি দেয়াল চাপা পড়ায় তিনি পা নাড়াতে পারছিলেন না। ঠিক তার পাশেই এক শ্রমিকের মৃত নাড়িভুঁড়ি পড়ে ছিল। তা থেকে বের হচ্ছিল উৎকট গন্ধ। আর পাখির কোমরে পড়েছিল আরেক সহকর্মীর লাশ। এ অবস্থাতেই তিনি জীবনের ৪৮ ঘণ্টা পার করেন। পাখি জানান, একটু দূরেই আরও তিনজন শ্রমিক তার মতোই বেঁচে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তারা অনেকবার ভেতর থেকে চিৎকার দিয়ে উদ্ধারকারীদের কাছে বাঁচার আহ্বান জানান। উদ্ধারকারীরা দেয়াল ছিদ্র করে পাখি ও তার অন্য সহকর্মীদের উদ্ধারের চেষ্টা চালান। কিন্তু পাখিকে বের করা সম্ভব হচ্ছিল না। এ অবস্থায় কোমরের নিচে থেকে পাখির পা দুটো কেটে মৃত্যকূপ থেকে উদ্ধার করা হয়।

পাখি বলেন, 'জীবনে আর কাজ কইরা খাইতে পারুম না। অভাবের কারণে ঢাকায় আইসা গার্মেন্টসে কাজ নিই কিন্তু এ গার্মেন্টস আমার পা দুইডা কাইড়া নিল। এহন সারা জীবন আমারে অন্যদের দয়ায় বাঁচতে হইবো।' কথাটি বলতে না বলতেই কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম নামে একটি প্রতিষ্ঠানের একদল কর্মকর্তা এসে পাখির হাতে চার হাজার টাকার একটি খাম তুলে দেন। তারা আগামী ১০ বছর পাখির চিকিৎসা ব্যয়ভার বহন করার ব্যাপারে আশ্বস্ত করেন।





দুই পা কাইটা আমারে তুইলা আনে_ শাহিনূর আক্তার

সাভার ট্র্যাজেডির ভয়াবহতার শিকার আরেক দুর্ভাগা নারী শ্রমিক হচ্ছেন শাহিনূর আক্তার (২৮)। ধসে পড়া ভবনের দেয়ালের নিচে আটকা পড়ে কাটিয়েছেন অমানবিক ৩০ ঘণ্টা। রংপুরের এ শ্রমিক অভাবের তাড়নায় কয়েক বছর আগে সাভারের রানা প্লাজার পোশাক কারখানায় কাজ নেন। কিন্তু সাভারের ঘটনাটি কেড়ে নিয়েছে শাহিনূরের দুটি পা। আর পা হারিয়ে এ শ্রমিক এখন ভাবছেন, যে ক্ষুধার জন্য ঢাকায় কাজ করতে এসেছিলেন সে কাজই তার পা কেড়ে নিয়ে আজীবনের জন্য পঙ্গু করে দিয়েছে। এ অবস্থায় ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন শাহিনূর।

এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিসিইউতে চলছে শাহিনূরের চিকিৎসা। পা হারিয়ে ব্যথায় কাতর শাহিনূরের অবস্থা আশঙ্কাজনক। কথা বলতেও যেন কষ্ট হচ্ছে। গতকাল দুপুরে শাহিনূর ধীরে ধীরে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, 'দেয়াল চাপা পইড়া আমার দুই পা আটকে যায়। এ অবস্থায় আমি বার বার হাত উঁচু কইরা বাঁচার লাইগা চিৎকার করতে থাকি। উদ্ধারকারীরা আইসা আমার পা কাইটা আমারে উপরে তুইলা আনে।' তিনি আরও বলেন, 'উদ্ধারকর্মীরা আমাগো খোঁজ পাইয়া প্রথমে খাবার খাইতে দেন। কিন্তু আমরা তখন খাবার খাওয়ার চেয়ে বাঁচার চেষ্টা করতাছিলাম। উদ্ধারকারীদের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাইতাছিলাম।' কথাগুলো বলতে বলতে ব্যথায় কাতর শাহিনূরের দুই চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। চিকিৎসকসহ উপস্থিতরা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেন।







হাত ছাড়া খুব অসহায় লাগছে_ লাবণী খানম

সাভারে ভবন ধসে বাম হাত হারিয়েছেন রানা প্লাজার এক গার্মেন্টের স্বাস্থ্যকর্মী (নার্স) লাবণী খানম (২০)। হাত হারানোর ব্যথায় তিনি ভালোভাবে নড়াচড়াও করতে পারছেন না। এনাম মেডিকেলের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন লাবণীর দেহ ঢেকে রাখা হয়েছিল সাদা চাদরে। কাটা হাতে বাঁধা ব্যান্ডেজে কাঁচা ক্ষত থেকে তখনো রক্তের প্রবাহ বন্ধ হয়নি। কিন্তু পঙ্গুত্ববরণ করে বাকি জীবন অস্বাভাবিকভাবে কাটাতে হবে এ চিন্তায় লাবণী এখন চিন্তিত। নতুন জীবন পেয়েও খুশি হতে পারছেন না বরং কী করে দুটো পয়সা রোজগার করে পরিবারের সদস্যদের দুঃখ মেটাবেন সে ভাবনায় অস্থির তিনি।

লাবণী জানান, ভবনটি ধসে পড়ার সময় ভূমিকম্পের মতো পুরো বিল্ডিং নড়ে ওঠে। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই পঞ্চম তলা থেকে তিনি ও তার সহকর্মীদের ওপর ভারী দেয়াল ও যন্ত্রপাতি পড়ে যায়। তারা ক্রমেই নিচের দিকে নেমে যেতে থাকেন।

লাবণী বলেন, 'আমার পাশে যারা কাজ করছিলেন তাদের একজনের অর্ধেক দেহ কাটা পড়ে আমার দেহের উপর পড়ে। আর বাম হাতের উপর ভারী বিম পড়ে। আর এক পা বুকের কাছে কোনোরকম রেখে আমি ৩৬ ঘণ্টা সেখানে আটকে ছিলাম।' তিনি জানান, সঙ্গে মোবাইল ফোন থাকলেও নেটওয়ার্ক না পাওয়ায় কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। সে সময় তিনি দোয়া ইউনুস পড়েন এবং আল্লাহকে স্মরণ করেন। বেশ কয়েক ঘণ্টা পর লাবণী মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করেন। কিন্তু উদ্ধারকারীরা তার কণ্ঠ শুনতে পাননি। পরে কিছু উদ্ধারকারী দেয়াল ছিদ্র করে লাবণীকে খুঁজে পান। তারা লাশের উটকো গন্ধে প্রথমে ভেতরে ঢুকতে না চাইলেও লাবণী তার হাতে থাকা মোবাইল ফোনসেটের আলো জ্বালান। তা দেখে উপর থেকে ছিদ্র করে উদ্ধারকারীরা তাকে উপরে তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু লাবণীর হাত ভারী দেয়ালের নিচে থাকায় ওঠানো যাচ্ছিল না। তাকে বাঁচাতে উদ্ধারকারীরা হাত কাটতে বাধ্য হন। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লাবণী বলেন, 'আমার আয়ের ওপর পরিবার নির্ভরশীল। হাত কেটে ফেলার পর থেকে নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন জায়গা থেকে অল্প কিছু অর্থ সাহায্য পেয়েছি। কিন্তু এ দিয়ে তো জীবন চলতে পারে না।'







পা হারিয়েও কষ্ট নেই_ লাভলী আক্তার

কতটা নির্মম পরিস্থিতির শিকার হলে একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে তার পা কেটে ফেলার কথা বলতে পারেন? লাভলী আক্তার পেরেছেন। কারণ তিনি যে ভয়াবহ নির্মম পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন সেখানে জীবিত ফেরত আসতে হলে লাভলীর পা কাটা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।

রানা প্লাজার তৃতীয় তলায় কাজ করতেন লাভলী। ঘুনাক্ষরেও ভাবেননি তার জীবনে এমন একটা ভয়াল মুহূর্ত নেমে আসবে।

গতকাল সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজের আইসিসিইউতে দেখা হয় এ দুর্ভাগা নারীর সঙ্গে। হাসপাতালের বিছানায় লাভলীর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন তার স্বামী। তিনি জানান, উদ্ধারকারীদের কাছ থেকে শুনেছেন যে, দুর্ঘটনার ২ দিন পরে লাভলীকে রানা প্লাজা থেকে উদ্ধার করে এ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তবে লাভলী যে দুই দিন ধরে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে ছিলেন সে সময় তার কোনো জ্ঞান ছিল না। উদ্ধারকারীরা লাভলীর শ্বাস-প্রশ্বাস পড়ছে দেখে ভারী বিমের ওপর থেকে টেনে তুলতে পারছিলেন না। এ অবস্থায় জ্ঞানহীন অবস্থায় তার একটি পা কেটেই তারা ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করেন। তবে জ্ঞান ফেরার পর লাভলী দেখতে পান যে তার একটি পা কেটে ফেলা হয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে লাভলী আক্তার বলেন, 'অনেক বড় ক্ষতি হয়েছে জানি। তবু কষ্ট নেই। শুধু জানি- আমি আমার স্বামী ও সন্তানদের কাছে জীবিত ফিরে যেতে পারছি, এটাই আমার অনেক বড় পাওয়া।'





লাশের পাশে ২৪ ঘণ্টা_ রুনা

'দরকার হলে বাকি জীবন ভিক্ষা কইরা খামু কিন্তু আর কখনো গার্মেন্টে কাজ করমু না।' কথাগুলো বলছিলেন সাভারের রানা প্লাজার নিউ ওয়েভ গার্মেন্টের সুইং অপারেটর রুনা আক্তার (১৮)। রানা প্লাজার দুর্ঘটনার পর ২৪ ঘণ্টা ভারী বিমের নিচে রুনার হাত আটকে ছিল। এ সময় তার পাশেই পড়ে ছিল সহকর্মীদের লাশ। কিন্তু কোনোভাবেই রুনা তার ভাঙা হাতটিকে টেনে বের করতে পারছিলেন না। জীবনের আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু অবশেষে অলৌকিকভাবে উদ্ধার পান তিনি।

বর্তমানে রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন রুনা। তিনি বলেন, 'বুধবার কারখানায় যাওয়ার এক ঘণ্টা পর সাততলা থেকে আমরা নিচে পইড়া যাই। সেই সময় একটি ভারী বিম হাতে আইসা পড়ে। আমি তা সরানোর চেষ্টা করি। পারি না। বুঝতে পারি একটি হাত ভাইঙা গেছে।' রুনা জানান, এ অবস্থায় দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা সহকর্মীদের লাশের পাশে নিরুপায় শুয়ে ছিলেন তিনি। রুনা বলেন, 'বাঁচার আশাও ছাইড়া দিছিলাম। এহন মনে হইতাছে দ্বিতীয় জীবন পাইছি। আমাগোরে ওভারটাইম দেওয়ার নামে বুধবার কারখানায় ঢুকানো হয়। বলা হয়, কাজে না গেলে বেতন কাটা হবে। আমার পাশেই আমার বান্ধবীগোরে মইরা পইড়া থাকতে দেখি। অনেকরেই চোখের সামনে মরতে দেহি কিন্তু কিছুই করতে পারি নাই। বাকি জীবন ভিক্ষা কইরা খামু কিন্তু গার্মেন্টে কাজ করমু না।'





পা কাটার পর খুব শান্তি পাইছি!_ সোনিয়া আক্তার



রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দুই দিন এক রাত ভারী দেয়ালের নিচে চাপা পড়ে ছিলেন গার্মেন্ট শ্রমিক সোনিয়া আক্তার (২০)। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় একটি পা হারিয়েছেন তিনি। বর্তমানে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) তার চিকিৎসা চলছে। ব্যথায় কাতর এ শ্রমিক জানান, তিনি রানা প্লাজার সাত তলায় কাজ করতেন। দুর্ঘটনার দিন হঠাৎ বিকট শব্দ করে ভবনটি ধসে পড়লে তার শরীরের ওপর ভারী দেয়াল ভেঙে পড়ে। সাত তলার শ্রমিকদের বেশির ভাগই মৃত্যুবরণ করেন। ভাগ্যবান কিছু মানুষ প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু পায়ের ওপর ভারী দেয়ালের কারণে সোনিয়া দুই দিন ধরে ধ্বংসস্তূপের নিচেই চাপা পড়ে ছিলেন। এ সময় তার পাশে পড়ে ছিল অসংখ্য লাশ। এ দুই দিন বাতাসের অভাব ও পানির তেষ্টায় প্রতি মুহূর্ত তার কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে। সোনিয়া জানান, তার পাশের এক জীবিত পোশাককর্মী কোনোমতে টেনেহিঁচড়ে টয়লেটে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কারণ সাত তলার টয়লেটটি তখনো ভেঙে পড়েনি। সেখানে গিয়ে তিনি উদ্ধারকর্মীদের বাঁচানোর জন্য আকুতি জানান। তিনি আরও জানান, দুই দিন ধরেই তিনি (সোনিয়া) দেয়ালে চাপা পড়া তার পা নাড়াচাড়ার চেষ্টা চালান। কিন্তু বারবারই ব্যর্থ হন। অবশেষে উদ্ধারকর্মীরা এসে দেয়ালের নিচে চাপা পড়া সোনিয়ার পা কেটে তাকে উদ্ধার করেন। সোনিয়া এ সময় ডুকরে কেঁদে উঠে এ প্রতিবেদককে বলেন, 'আমার পা কাটার পরও আমি কষ্ট পাইনি বরং পা কাটার পর খুব শান্তি পাইছি। মনে হইছে শরীরের উপর থেইক্যা হাজার টনের বোঝা নাইমা গেছে। আসলে আমার বাবা চায় নাই যে আমি গার্মেন্টে কাজ করি। আমার স্বামীরে নিয়া আমি কয় দিন আগে গার্মেন্টে কাজ নেওয়ার লাইগা বাড়ি থেইকা পলায়া আসি। বাবার কথা না শুই না আজ আমার এ দশা!'

কথা বলতে বলতে সোনিয়ার সামনে একটি বেসরকারি সংস্থার কয়েকজন এসে দাঁড়ান। তারা পরম মমতায় সোনিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। তাদের একজন সোনিয়ার হাতে একটি খাম ধরিয়ে দিয়ে বলেন, 'এখানে আপনার চিকিৎসার জন্য কিছু অর্থ রয়েছে।' সদ্য পা হারানো সোনিয়ার চোখের জল তখনো শুকায়নি। বিড়বিড় করে তিনি বলে যান, 'আমি তো চিরজীবনের লাইগা পঙ্গু হইয়া গেলাম। সামান্য এ অর্থসাহায্যে আমি বাকি জীবন কেমনে পার করমু?'



পোলারে নিয়া কি খাইয়া বাঁচমু?_ জেসমিন আক্তার



জেসমিন আক্তার (২৪)। কাজ করতেন সাভারের রানা প্লাজার গার্মেন্টে। গত বুধবারের ভবন ধসে গুরুতর আহত হয়ে এখন আশঙ্কাজনক অবস্থায় সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি জানান, দুর্ঘটনার দুই দিন পর তাকে ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা হয়। শারীরিক জখমের কারণে তিনি হয়তো আর কাজ করতে পারবেন না। এ অবস্থায় স্বামীহীন এ নারী তার এক সন্তানকে নিয়ে কীভাবে বাঁচবেন তা নিয়েই দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।

গতকাল সাভারে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে কথা হয় জেসমিনের সঙ্গে। তিনি জানান, তৃতীয় তলার একটি কারখানায় কাজ করতেন। দুর্ঘটনার পর পাশে রাখা ভারী মেশিন তার শরীরের ওপর পড়ে। এ অবস্থায় আশপাশে মৃত মানুষের সঙ্গেই অন্ধকারে তাকে গরমের মধ্যে দুই দিন পার করতে হয়। তারপরও উদ্ধারের আশা ছাড়েননি এ নারী শ্রমিক। তিনি বলেন, 'আমার পাশেই মেশিনের ফাঁক দিয়ে একটু গর্ত দেখা যাইতাছিল। আমি মানুষদের কথা বলার আওয়াজ শুইনা তাগোরে আমারে বাঁচানোর অনুরোধ করি। এর পর উদ্ধারকারী ভাইরা আমারে সেখান থেইক্যা তুইলা আনেন।' তবে দুই দিন ভারী যন্ত্রপাতির নিচে চাপা পড়ে থাকার কারণে জেসমিনের মেরুদণ্ডের হাড় ভেঙে গেছে। তার কিডনিসহ অন্যান্য শারীরিক সমস্যাও দেখা দিয়েছে। জেসমিন এখন নিজের হাতে পানি তুলেও খেতে পারছেন না। এ অবস্থায় নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন জেসমিন। তিনি বলেন, 'আমার স্বামী নাই কিন্তু এক ছেলে আছে। মনে হইতাছে বাকি জীবনে আর ভারী কাজ কইরা খাইতে পারমু না। চিন্তা হইতাছে পোলারে নিয়া এখন কি খাইয়া বাঁচমু?'





মৃত সহকর্মীর টিফিন খেয়ে ৩০ ঘণ্টা_ পারভিন

সাভারের রানা প্লাজার ভবন মালিকের দায়িত্বহীনতার জন্য পাখি, সোনিয়াদের মতো হাত-পা না হারালেও হাত ও পায়ের হাড় ভেঙে মারাত্দক আহত অবস্থায় এনাম মেডিকেলের আইসিসিইউতে চিকিৎসাধীন গার্মেন্ট শ্রমিক পারভিন আক্তার (১৮)। তিনি নয়তলায় কাজ করতেন। দুর্ঘটনার পর ৩০ ঘণ্টা তিনি ধ্বংসস্তূপের নিচে মৃত সহকর্মীর পাশে শুয়ে থেকে তাদের টিফিন খেয়ে কাটিয়েছেন বলে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান। তিনি নিজের ও তার সহকর্মীদের এ করুণ পরিণতির জন্য গার্মেন্ট মালিকদের দায়ী করেন। বলেন, আর কখনোই গার্মেন্টে চাকরি করবেন না।

গত বুধবারের রানা প্লাজার দুর্ঘটনার কথা স্মরণ করে পারভিন বলেন, 'যেদিন ভবন ধইসা পড়ে সেদিন সকালে রানা প্লাজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি। জীবন হারানোর ভয়ে কেউই সেখানে ঢুকতে চাই নাই। কিন্তু আমাগোরে টাকা কাটার ভয় দেখাইয়া কামে নেওয়া হয়। আমরা প্রথমে কাজে একদম মন বসাইতে পারতাছিলাম না। ভয় হইতাছিল এই বুঝি বিল্ডিং ভাইঙ্গা পড়ে। মনে মনে দোয়া করতাছিলাম আর দেহি একটু পরেই একটা আওয়াজ হইল। বুঝলাম আমরা সবাই হুড়মুড় কইরা নিচে নাইমা পড়তাছি।' পাখি বলেন, 'আমার ভাগ্য ভালো ছিল তাই আমি একটা গর্তের মধ্যে পইড়া ছিলাম। তবে ভারি মেশিনের ওপর চাপা পড়ার জন্য কোনোভাবেই সেখান থেইক্যা বের হইতে পারতাছিলাম না। এর ওপর হাত ও পায়ের হাঁটুর হাড় ভাইঙ্গা যাওয়ায় নড়াচড়া করতেও অনেক কষ্ট হইতাছিল।' তিনি বলেন, 'অনেকক্ষণ পর আমার মাথার ওপর দিয়া মানুষের হাঁটাচলার শব্দ শুনতে পাই। সঙ্গে সঙ্গে বাঁচাও বাঁচাও কইরা চিৎকার করি। একটু পর মানুষ আমার ওপর আলো ফেলাইয়া দেখে যে আমি তখনো নিঃশ্বাস নিতাছি। আমি তাগোরে কই, আমারে আপনারা বাঁচান। পরে সেখান থেকে আমারে উদ্ধার করা হয়। আশপাশের মৃত মানুষের গন্ধে আমি বেশ কয়েকবার বমি করি। পিপাসা পাইলে মৃত সহকর্মীদের আনা টিফিন ও পানি অল্প অল্প কইরা খাই। দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা সহকর্মীদের লাশের পাশে নিরুপায় শুইয়া ছিলাম। বাঁচার আশা ছাইড়া দিছিলাম। এহন মনে হইতাছে দ্বিতীয় জীবন পাইছি।'

পারভিনের মনে সাভার ট্র্যাজেডি অনেক বড় দাগ কেটেছে। তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, 'বাঁইচা থাইকলে ভবিষ্যতে ভিক্ষা কইরা খামু। কিন্তু জিন্দেগেতি আর কখনো গার্মেন্টসের চাকরি করমু না।'