হাসিনা খালেদার মিল-অমিল


কাজল ঘোষ: দু’নেত্রীর মিল-অমিল খুঁজতে যাওয়া সত্যিই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। পাশ্চাত্য দুনিয়ার মিডিয়ায় দু’জনই ব্যাটলিং বেগমস বলে শিরোনাম হয়েছেন একাধিকবার। আদতে জনগণও তাই দেখছে। সুযোগ পেলেই রাজনীতির অ আ না বুঝা মানুষও বলে ওঠেন এরাই সব শেষ করলো। দেশটার বারোটা বাজালো। মিল শুধুই কি তাহলে ওখানে। ইতিহাসের পাতা উল্টালে আরও অনেক ক্ষেত্রেই দু’ নেত্রীকে এক কাতারে দাঁড় করানো যায়। ভাঙা-গড়ার খেলা নিয়েই দু’জন দেশের শীর্ষ আসনটি বাগিয়ে নিচ্ছেন। শুরু করেছেন খালেদা জিয়া। অনেকটা নাটকীয় ও সব হিসাব বদলে দিয়ে হয়েছিলেন প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। নব্বইয়ের গণআন্দোলনে সবাই ভেবেছিলেন পনের দলীয় জোট নেত্রী হাসিনাই হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু না। ভোটের বাক্সে এগিয়ে গেলেন সাত দলীয় জোট নেত্রী খালেদা জিয়া। মন খারাপ করে, ব্যর্থতা নিয়ে শেখ হাসিনা সেবার দল থেকে পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। বাদ সাধলেন দলের নেতাকর্মীরা। এটাই ছিল টার্নিং পয়েন্ট। ধীরে ধীরে মোড় ঘুরিয়ে দিলেন রাজনীতির। বিএনপির প্রথম জমানায় মাগুরা নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে রাজপথে সরব হলেন। সকল বিরোধী পক্ষকে এক কাতারে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুললেন। আপসহীন নেত্রীর খেতাব পাওয়া খালেদা জিয়াকে দাবি মানতে বাধ্য করলেন। ক্ষমতায় এলেন। তারপর মুদ্রার এপিট আর ওপিট। দু’জনই ক্ষমতায় এসেছেন পরপর চারবার। মাঝখানে অল্পদিনের জন্য খালেদা জিয়া আরও একবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।  সব হিসেব গড়মিল করে দিলো ওয়ান-ইলেভেন। দু’জনই কারাগারে কাটালেন। কাছাকাছি সময়ে কাছাকাছি বসবাস। রাজনীতিতে নানা সংস্কারের আওয়াজ। দু’দলেই অস্থিরতা। ফৌজি শাসনের ছায়ায় দেশ চললো দু’বছর। রাজনীতিকরা একের পর এক বন্দি হলেন। নতুন কিছু পকেট দলের সূচনাও ঘটলো। দু’নেত্রীর নামে একাধিক মামলা হলো। বিচার চললো। রাজনীতিতে মীর জাফর, মদন লাল আর রাজবল্লভদের চেনা হলো। জনগণ মুখিয়ে উঠলেন গণতন্ত্রের জন্য। মিডিয়া একাই লড়লো জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দিতে। দু’জনই মুক্ত হলেন। একজন ধানমন্ডির সুধাসদনে আর অন্যজন নয়াপল্টনে দলের কার্যালয়ের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কাঁদলেন। নতুন ভাবনায় দেশকে এগিয়ে নেয়ার কথা বললেন। তারপরের কথাতো সবারই জানা। সরব হলো রাজনীতির মাঠ। নতুন হিসাব-নিকাশ।  নির্বাচন হলো। বঙ্গবন্ধু কন্যা ক্ষমতায় এলেন। একজন প্রধানমন্ত্রীর আসনে। অন্যজনের দু’পুত্র মামলার বেড়াজালে দেশের বাইরে। একাকিত্ব। দলের শোচনীয় পরাজয় মাথায় নিয়ে নিজেকে গড়তে লাগলেন। জনগণের ভোটের লড়াইয়ে হাসিনার ফর্মুলা কব্জা করেই রাজপথের লড়াইয়ে নয়া শক্তি নিয়ে হাজির হলেন। রোডমার্চ আর জনসংযোগে জনগণকে সংঘটিত করতে লাগলেন। অন্যদিকে খালেদার আপসহীন তকমা গায়ে লাগালেন হাসিনা।
খালেদাকে এক সকালে ছাড়তে হলো স্মৃতি বিজড়িত মঈনুল রোডের বাড়ি। সংবাদ সম্মেলনে কাঁদলেন। জনতার কাছেই বিচারের ভার তুলে দিলেন। হাসিনাকেও বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল প্রথম জমানায় ক্ষমতায় ছাড়ার অল্পকাল পর। শেষ মুহূর্তে গণভবন লিখে নিয়েছিলেন এক অধ্যাদেশে। চারপাশে সমালোচনা হয়েছিল। নিরাপত্তার খাতিরে তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি বঙ্গবন্ধু পরিবার। বিএনপি ক্ষমতায় এসে তা বাতিল করলে তাকেও বেরিয়ে যেতে হয়েছিল গণভবন থেকে। অ™ভূত রকমের মিল দু’ নেত্রীরই। জ্যোতিষীরা বরাবরই এক নেত্রী ক্ষমতায় থাকলে অন্য নেত্রীর রাজনীতিতে সুফল পাবার সম্ভাবনার কথা বলেন। আশঙ্কার পাল্লা ভারি রাখেন ক্ষমতায় যিনি থাকেন তার জন্য। দু’নেত্রীর ভবিষ্যৎ নিয়ে ওয়ান ইলেভেনে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সংস্কারপন্থিদের নানা ফর্মুলায় তার রূপরেখা আঁকা হয়েছে। বিএনপির প্রয়াত মহাসচিব মান্নান ভূঁইয়া তার দেয়া সংস্কার প্রস্তাবে নির্দিষ্টভাবেই বেগম জিয়াকে মাইনাস করার কথা বলেছিলেন। এর আগে শেখ হাসিনা ৬০ বছরের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে কার্যত নিজেকে সরিয়ে নেয়ার রূপরেখা দিয়েছিলেন। দু’জনের পারিবারিক জীবনও আচানক একই রকমের ঘটনায় আন্দোলিত। একজন পঁচাত্তরের নির্মমতা বুকে নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। রেহানা ছাড়া পরিবারের সবাইকে হারিয়েছেন। অন্যজন স্বামী প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় শহীদ হয়েছেন সেই কষ্ট বুকে নিয়েই পথ চলেছেন। বর্তমানে দুজনেরই সন্তান-সন্ততিরা বিদেশ বিভুইয়ে। হাসিনা পুত্র-কন্যা জয় পুতুল বাইরেই আছেন অনেককাল। খালেদা জিয়ার দু’পুত্র তারেক কোকো ওয়ান-ইলেভেনে কারাগার থেকে চিকিৎসার জন্য বাইরে গেলে আর ফিরতে পারেননি। দু’জনের রাজনীতিতে আবির্ভাব সত্যিই নাটকীয়। জনগণ যতই দু’নেত্রীকে দোষারোপ করুক দেশ পরিচালনার ব্যর্থতা নিয়ে। কিন্তু রাজনীতিকরাই তাদের হালুয়া-রুটির ভাগ নিতে দু’জনকে দলের দায়িত্বে নিয়ে এসেছেন। আওয়ামী লীগ-বিএনপির দুর্যোগে দু’জনই দলের হাল ধরেছেন। খালেদা জিয়া ছিলেন আটপৌরে গৃহবধূ। দেশের সশস্ত্র বাহিনীর পদস্থ কিংবা পরে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সহধর্মিণী হয়েও প্রকাশ্যে খুব কমই দেখা গেছে। দলের শীর্ষ নেতাদের অনুরোধে ১৯৮৩ সালে দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাজনীতিতে অভিষেক।  এরপর দলের চেয়ারপারসনের দায়িত্ব নেয়ার পর আর পিছনে ফিরে তাকাননি। জেনারেল এরশাদের সময় স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে সামরিক সরকারের অধীনে নির্বাচনের না যাওয়ার ঘোষণায় অটল থেকে অর্জন করেছিলেন আপসহীন নেত্রীর পরিচিতি। ১৯৮৩ থেকে ২০১৩ সাল। সকল প্রতিকূলতায় দলের চেয়ারপারসনের দায়িত্ব নিয়ে কখনও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হননি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও দলের শীর্ষ নেতাদের অনুরোধেই দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। দূর প্রবাসে গৃহবধূর জীবন যাপন করছিলেন। পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট ট্রাজেডি মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল হাসিনার জীবনে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায়। দলের প্রবীণ নেতাদের কথায় নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটান। দায়িত্ব নেন সভানেত্রীর। নানা উত্তান-পতনের খেলায় দলকে ২১ বছর পর ক্ষমতায় আনেন ১৯৯৬-তে। দলের ভাঙন আর সংস্কারের নানা মোর্চাতেও বৃহৎ এই দলের নেতৃত্ব নিয়ে কখনও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হননি। রাজনীতির কৌশল হিসেবে দু’নেত্রীই বিতর্কিত দল ও নেতৃত্বকে কাছে ভিড়িয়েছেন আবারও সমভাবে দূরেও ঠেলে দিয়েছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে মাঠে একসঙ্গে আন্দোলনে করেছে অওয়ামী লীগ জামায়াতের সঙ্গে। ক্ষমতায় এলে লক্ষ যোজন দূরে ঠেলে দেয়া হয়েছিল জামায়াতকে। বিএনপির প্রথম জমানায় আওয়ামী লীগই ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ব্যানারে গড়ে তুলেছিলেন যুদ্ধাপরাধ বিচারে তীব্র আন্দোলন। নানা বিতর্ক সত্ত্বেও এবার ক্ষমতায় এসে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তা শুরু করেছেন। অন্যদিকে বিএনপি আরও একধাপ এগিয়ে। ক্ষমতায় যেতে রাজপথে জোট গড়েই তারা ক্ষ্যান্ত হয়নি। ক্ষমতার অংশীদার করেছে গাড়িতে তুলে দিয়েছে জাতীয় পতাকাও। দু’নেত্রী স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে পতন ঘটিয়েছেন।  কিন্তু চাকা ঘুরতেই এরশাদকেও ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি করতে দু’দলই নানাভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। বর্তমান সরকারও মহাজোট গড়েছে এরশাদকে নিয়ে। তারই ভাই জিএম কাদেরকে করেছে মন্ত্রী। নানা সুবিধা প্রাপ্তি বিবেচনায় এরশাদও  আজ এটা তো কাল ওটা বলে কখনও সকার বিরোধী আবারও কখনও সরকারের দুঃসময়ের কাণ্ডারি হতে চেয়েছেন।
নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। আলোচনার নানা ডালপালা গজাচ্ছে। দেশ একর পর এক দুর্যোগে আবর্তিত হচ্ছে। সবেশেষ সাভার ট্রাজেডির নির্মমতায় দেশ কাঁদবে বহুকাল। শুধু অশ্রুপাতই কি এর সমাধান। দু’নেত্রী ছুটে গেছেন সাভারে। স্বজনহারাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিরোধী নেত্রী এই নির্মমতার সঙ্গে যুক্তদের বিচারে অন্য দাবির সঙ্গে যুক্ত করে একদিনের হরতাল ডেকেছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আহবানে তিনি হরতাল প্রত্যাহার করে উদারতার পরিচয় দিয়ে রাজনীতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছেন। সকল দুঃখ জাগানিয়া দুঃসময়েও এটি আমাদের জন্য ভালো খবর। সময় নেননি প্রধানমন্ত্রী। সংসদে দাঁড়িয়ে বিরোধীদলকে এজন্য ধন্যবাদ দিয়ে সৌজন্য অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। বিরোধী নেত্রী প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে দু’কথা লিখেছেন। ভবিষ্যৎ সঙ্কট সমাধানে জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রীকে সাড়া দিতে আহ্বান জানিয়েছেন। আমজনতা অপেক্ষায় কি হয় তা দেখার জন্য। দেশের সকল মানুষ দু’নেত্রীকে উ™ভূত পরিস্থিতি দেখকে দেশকে সামনে এগিয়ে কার্যকরী উদ্যোগে দেখতে চান। পালাপাল্টি গালমন্দের সংস্কৃতি বদলে ধন্যবাদের উদার প্রচলন প্রত্যাশা করে।
হাসিনা খালেদা তাদের জীবদ্দশায় রাজনীতিতে অপাংক্তেয় হয়ে যাবেন এই চিন্তা বাস্তবতা বিবর্জিত। সংস্কারের প্রয়োজন আমাদের চিন্তা চেতনায়। বর্তমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার নিজস্ব স্বতঃস্ফূর্ত উদার ও দেশদরদী সিদ্ধান্তই হতে পারে সহজ, কার্যকর ও সুবিধাজনক সমাধান। কথায় আছে, দুর্যোগ সুযোগ এনে দেয়। আমাদের একেকটি দুর্যোগে ব্যাপক সংখ্যক মানুষের এগিয়ে আসা; অকাতরে নিজেকে বিলিয়ে দেয়া প্রমাণ করে এ জাতি শত প্রতিকূলতাতেও ঘুরে দাঁড়াতে পারে।